চিরকুট
:- এই শুন
:- কি..??
:- গত তিন দিন কই ছিলি...??
:- কই আবার, বাড়িতে
:- ক্লাশে আসিস নাই ক্যান...??
:- এমনিতেই
:- এমনিতে মানে কি...??
:- এমনিতে মানে এমনিতেই
:- ভালো হচ্ছেনা কিন্তু, বলে দিলাম,
:- ক্যান...? আমি খারাফের কি করলাম,
:- তুই ক্লাশে ঠিক মতো আসিস না ক্যান ..??
:- ভাল্লাগেনা তাই আসি না ।
:- আবারও একি কথা, ভাল্লাগেনা ক্যান ..?
:- বললাম না, এমনিতেই
:- তুই আর ক্লাশ মিস করবি না
:- ক্যান..? আমি ক্লাশ মিস করলে তোর ক্ষতি কি. ?
:- অনেক বড় ক্ষতি
:- যেমন......?
:- তোকে না দেখে আমি ভালো থাকতে পারি না , একদিন এর জন্যও চোখের আড়ালে তোকে যেতে দিতে চাই না।
:- হে....হে , তোর ভালো থাকা লাগবে না , আর আমাকেও দেখতে হবে না।
:- তুই এমন কেনো...?? ব্যাপার টা একটু সিরিয়াসলি নে ..
:- সিরিয়াসলি ....? আমি তো সিরিয়াসলি নিছি, কই তেমন কিছু দেখছি না তো.
:- দ্যাখ, ভালো হচ্ছেনা কিন্তু, তুই আমার সাথে মজা করচিস কেনো...?
:- কই মজা করলাম, ক্লাশের সময় হইচে ক্লাশে আয়
:- তুই যা, আমি যাবো না
:- ক্লাশে যাবি না, তাইলে কই যাবি..?
:- জাহান্নামে যামু, তাতে তোর দরকার কি ..??
:- দাড়িয়ে আছিস কেনো, জলদি যা, জাহান্নামের ফেরেস্তা তোর জন্য দাড়িয়ে আছে।
:- যাচ্ছি, তুই খুশি তো ..?
:- হু, অনেক খুশি, ঘাড়ে থাকা পেত্নী থেকে মুক্তি পামু
:- কি..? আমি পেত্নী ..? তুই আমাকে পেত্নী বললি..??
:- হু, তুই পেত্নী থেকেই বা আর কম কিসে ....
:- তোর সাথে আর কথাই বলবো না, তুই তোরে নিয়ে থাকিস
:- যাস নাই এখনো, দূরে গিয়ে আমাকে মুক্তি দে
ক্লাশ না করেই ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেলো ফারাবি, বাসায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে বেশ কিছুক্ষণ কেঁদে মনটা হালকা করলো ।
ছেলেটার মাঝে আজ কয়েকদিন বেশ পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে ফারাবি। ঠিক মতো ক্যাম্পাসে আসে না, ক্লাশ ও করে না আর কেমন যেনো ফারাবি কে দূরে ঠেলে দিতে চায়, ফারাবির কোনো কথাই সে কানে নিতে চায় না, হাসিরচলে সব এড়িয়ে যায় , ফারাবি বুঝতে পারছে না অন্তু কেনো তার সাথে এমন করে।
অন্তু এবং ফারাবি দুজনেই সমবয়সী , ভার্সিটিতে একই ডিপার্টমেন্ট এ পড়াশুনা করে। এইচ এস সি পরীক্ষা শেষে ফার্মগেটে কোচিং সেন্টারেই তাদের পরিচয় এবং সেখানেই তাদের মাঝে গড়ে উঠে বন্ধুত্ব। তারপর দুজনেই একই ভার্সিটি এবং একই ডিপার্টমেন্ট ভর্তি । বেশ ভালোই ছিলো দুজেনর দিনগুলি, চলে এসেছিলো একে অন্যের খুবই কাছাকাছি। এক জন অন্যজন কে না দেখে থাকতে পারতো না । বন্ধুত্বের সম্পর্ক তাদের মাঝে রূপান্তরিত হয়েছিলো ভালোবাসায় কিন্তু হারানোর ভয়ে কেউই কাউকে বলতে পারে নি । অন্তু বেশ কয়েকবার বলতে চেয়েছিলো .... ফারাবি আমি তোকে ভালোবাসি, অনেক ভালোবাসি, কিন্তু ফারাবি যদি তার জীবন থেকে হারিয়ে যায় তা ভেবে আর বলতে পারে নি । অার ফারাবি চেয়েছিলো অন্তু নিজে থেকে তাকে বলুক ভালোবাসার কথা ।
আজ কয়েকদিন অন্তুর ব্যাবহার ফারাবির নিকট মোটেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না, অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে সে, যেখানে কখনো ক্লাশ মিস করতো না কিন্তু সেখানে সে এখন ক্লাশে ঠিক মতো আসতে চায় না । আর যেখানে অন্তু সারাক্ষণ ফারাবির পিছে লেগে থাকতো এখন ফারবি অন্তুর পিছনে লেগে থাকে যা অন্ত বুঝে ও না বুঝার চেষ্টা করে অথবা বুঝার চেষ্টা করে না ।
মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে ফারাবির, মোবাইলের দিকে চেয়ে দেখে রাত দশটা চুঁইচুঁই । কললিষ্ট দেখে দেখলো অন্তুর কোনো কল নাই, মেসেন্জার ওপেন করে দেখে সেখানেও তার কোনো মেসেজ নাই । বেশ অবাক লাগছিলো ফারাবির নিকট ব্যাপারটা, অন্যদিন গুলোতে কয়েক বার কথা হতো দুজনের , কিন্তু আজ অন্তু একবারের এর জন্য মেসেজ অথবা কল দিলো না। ফারাবি নিজে থেকে কল দিলো অন্তুর ফোনে বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর অন্তু ফোন তুললো ..
:- হ্যালো..!
:- কিরে কেমন আছিস...?
:- ভালো, তুই কেমন আছিস ..?
:- ভালো, তুই আজ আমাকে ফোন দিলি না ক্যান..??
:- এমনিতেই দেই নি, ভাল্লাগছিলোনা
:- আমার সাথে কথা বলতে তোর ভালো লাগে না, তাই না..?
:- হু,
:- তোরে আমি বেশ বিরক্ত করি, তাই না..?
:- হু, এতোকিছু যেহেতু বুঝেছিস তাহলে আবার ফোন দেস কেনো..??
:- ঠিকই বলছিস, আমি তো একটা বেহায়া তাই বারবার তোকে ফোন দিচ্ছি, আজকের পর আর দিবো না
:- আমি ও চাই না, তুই আমাকে আর কখনো দিস
:- তুই ভুলে গেছিস আমাদের সম্পর্ক...?
:- না ভুলারই বা কি অাছে , আমাদের মাঝে এমন কোনো সম্পর্ক ছিলো না যে তোকে সর্বদা মনে রাখতে হবে।
:- আমাদের বন্ধুত্ব তোর নিকট কিছুই মনে হচ্ছে না...??
:- না, কিছুই না, লাইফে অনেক ফ্রেন্ডই আসে তাদের সবাই কে কি মনে রাখতে হবে ...?
:- আচ্ছা তুই এতো স্বার্থপর কেনো..??
:- হ্যাঁ , আমি অনেক স্বার্থপর , তাতে কি ..??
:- বেশ বলেছিস, তোর নিকট আমি এখন কিছুই না
:- হু, কিছুইনা, এবার ফোন রাখ , আর কখনো ফোন দিবি না ।
অন্তু ফোন কেটে দিয়ে ফোনের সুইচ অফ করে ফেললো, ফারাবি আর ফোন দেওয়ার ট্রাই করলো না।
বেশ কিছুক্ষণ কান্না করে নিজেকে শক্ত করে নিলো , অন্তু কে ভুলে যাবে সে, অন্তুর সাথে আর কখনো যোগাযোগ রাখবে না।
গত কয়েকদিন ধরে ফারাবি একটা বিষয় লক্ষ করলো অন্তু ক্যাম্পাসে আসে না, অন্তুর সাথে জেদ করায় ফারাবি তা নিয়ে মাথা ঘামালো না,
দুইমাস পর ,
আজ সেমিষ্টার ফাইনাল , ফারাবি পরীক্ষা দিতে এসেছে, চারদিকে অন্তুকে খোঁজছে, গত দুমাসে ছেলে টা একবার ও ক্যাম্পাসে আসে নি, ভাবছিলো আজ পরীক্ষার দিন তো সে ঠিকেই আসবে । পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো কিন্তু অন্তু আসলো না। ফারাবি বেশ চিন্তিত হয়ে বাড়ি ফিরলো। অন্তুর ফোনে কল দিয়ে সংযোগ ফেলো না, ফেসবুকে গিয়ে আইডি ডিএকটিব দেখতে পেলো। ফারাবির নিজের কাছেই খুব খারাফ লাগছিলো দুমাস আমি তার সাথে একবার ও যোগাযোগের চেষ্টা করে নি । ফ্রেস হয়ে হালকা কিছু খেয়েই ফারিয়া কে নিয়ে চলে আসলো অন্তুর বাসায়, ফারিয়া ফারাবির কাজিন সমবয়সীই দু-একবছরের ব্যাবধান হবে । অন্তু বাসায় যেয়ে দেখে বাসার দরজা বন্ধ । দারোয়ান কে ডেকে বললো উনারা কোথায় .. ?
দারোয়ান বললো... দুমাস আগে অন্তু ভাইয়ার কি জানি অসুখ হইছিলো পরে অ্যাম্বুলেন্স আইসা অন্তু ভাইয়ারে হাসপাতালে নিয়ে যায়, এরপর গতমাসে অন্তু ভাইয়ার মায় আইসা বাসা ছাইড়া দেয় এবং তাগো গেরামের বাড়িত চইলা যায়।
দারোয়ান এর কথা শুনে ফারাবির মন হুহু করে উঠলো, অন্তুর কিছু হয়নি তো..??
দারোয়ানের নিকট থেকে অন্তুর গ্রামের ঠিকানা নিয়ে ফারাবি ফারিয়াকে সাথে নিয়ে চলে আসে অন্তুর গ্রামে । বেশ শুনশান এলাকা, গ্রামের আবহাওয়া খুবই মুগ্ধকর, এবারই প্রথম ফারাবি এবং ফারিয়ার গ্রামে আসা। বেশ ভালোই লাগছিলো তাদের গ্রাম্যরূপ, কিন্তু ফারাবির মনে ছিলো অজানা শঙ্কা । ঠিকানা অনুযায়ী ফারাবিরা পৌছে গেলো অন্তুদের বাড়ি , নিরব চারপাশ ছোট্ট একটি বাড়ি । দরজায় গিয়ে ডাক দিলে অন্তুর ছোট বোন নিতু এসে দরজা খুলে দেয় ।
নিতুর বয়স সম্ভবত ১৩ কিংবা ১৪ হবে , খুবই নম্রভদ্র একটি মেয়ে।
নিতু কে উদ্দেশ্য করে ফারাবি .....
:- কিরে নিতু কেমন আছিস...??
:- এইতো ভালো আপু, তুমি কেমন আছো ..?
:- আমিও ভালো, ঘরে আর কেউ নাই কাউকে দেখছি নাতো ..?
:- হুম, আম্মু আছে ,
:- অন্তু কই...??
:- ভাইয়া তো........
এরইমধ্যে নিতুর মায়ের ডাক......
:- কে এসেছেরে নিতু
:- আম্মু ফারাবি আপু,
:- ওদের ভিতরে আসতে বল ।
নিতু, ফারাবি ,ফারিয়া ঘরে প্রবেশ করলো, এবং ফারাবি অন্তুর মাকে সালাম দিয়ে বললো ...
:- আন্টি কেমন আছেন ..?
:- হ্যাঁ , মা ভালোই আছি, তোমরা কেমন আছো ..??
:- আমরা ভালো আছি, অন্তু কেমন আছে..? ওকে দেখছি না যে ...
অন্তুর মা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,
অনেক ভালো আছে অন্তু, অনেক দিন আমি নিতু কেউই অন্তু কে দেখছি না, এমন কি কখনো দেখবোও না । ছেলেটা আমার অনেক বোকা ছিলো , আমার আগেই সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো। তোমার সাথে ও অনেক খারাফ ব্যাবহার করেছিলো তাই না..? তুমি মা আমার অন্তুকে ক্ষমা করে দিও । জানো , মরিবার পূর্বে সে বারবার তোমাকে দেখতে চাইছিলো, কিন্তু দূর্ভাগ্য ছেলেটার শেষ ইচ্ছেটা পূর্ণ করে মরতে পারলো না, জানিনা এখন কেমন আছে ও ।
অন্তুর মা, একটি চিরকুট বের করে দিয়ে বললো .. ধরো মা, অামার অন্তু সেদিন রাতে এই চিরকুট খানা দিয়ে বলেছিলো যেন এটা আমি তোমাকে দেই।
অন্তুর মায়ের কথা শুনে ফারাবির মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো , জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সে, ভীষণ ভালোবাসতো অন্তুকে, এমন করে যে তার ভালোবাসার মৃত্যু হয়েছে, কিছুতেই মেনে নিতে পারছে ও । জ্ঞান ফেরার পর চিরকুটটা হাতে নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে খুললো এবং পড়তে লাগলো অন্তুর হাতে লিখা চিরকুটটি।
"প্রিয় ফারাবি ভালোবাসা নিস, কেমন আছস তুই ..? ভালোছিলি, কিন্তু এখন নিশ্চয়ই তুই ভালো নেই, চিঠি যখন হাতে পাবি তখন তো আর তুই ভালো থাকতে পারবি না , বেষ্টফ্রেন্ডের মৃত্যু হয়তো তুই মেনে নিতে পারবি না। শেষ কয়েক দিন তোর সাথে আমি এমন করায় তুই এখনো আমার সাথে রাগ করে আছিস, কিন্তু কি করবো বল, এছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিলো না। আমি তোকে অনেক ভালোবাসতাম, কিন্তু তুই হারিয়ে যাবি আমার জীবন থেকে এই ভেবে আর বলিনি । অনেকবার আমি তোকে ভালোবাসি কথাটি বলতে চেয়েছি কিন্তু পারি নি , বলতে গিয়ে বারবার এড়িয়ে গেছি । আমি জানি তুইও আমাকে ভালোবাসিস , তাই শেষদিন গুলোতে তোর সাথে খারাফ ব্যাবহার করছি যাতে তুই আমাকে ভুলে যাস। যেদিন জানতে পেরেছিলাম আমার কিডনী দুটাই অচল সেদিন থেকেই আমি তোর থেকে দুরে থাকতে চেয়েছি , যাতে তুই আমাকে ভুলে যাস , কিন্তু পারলি না ভুলতে, আর পারবিও না ভুলতে । তোকে বলি, তুই আমাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করবি, আমার জন্য কখনো মন খারাফ করবি না , দোয়া করিস আমার জন্য । আমি ও দোয়া করি তোর জন্য যাতে তুই সুন্দর ও ভালো ভাবে জীবন কাটাতে পারিস ।
ইতি,
তোর অন্তু
দুচোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু বইতে লাগলো ফারাবির, নিতু কে সাথে নিয়ে অন্তুর কবরের পাশে গিয়ে অন্তুর কবর আকড়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলো এবং বললো তুই এতটাই স্বার্থপর আমাকে একা রেখেই এভাবে চলে গেলি, আমিও তো ভালোবাসতাম তোকে খুব, এখনো ভালোবাসি ।
#চাইরচোখ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন